সিলেট জেলা বিএনপিতে নেতৃত্ব সংকটঃ তিন বলয়ের সংঘাত ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দীর্ঘদিন ধরে সিলেট জেলায় নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে। স্থানীয় পর্যায়ে দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সঠিক নেতৃত্বের অভাব, দলীয় কোন্দল ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের আধিপত্য সিলেট বিএনপিকে দুর্বল করে ফেলেছে। বর্তমানে জেলার রাজনীতিতে তিনটি পৃথক বলয় সক্রিয়, যার প্রত্যেকটির রয়েছে নিজস্ব সুবিধা-অসুবিধা ও অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন।
আরিফুল হক চৌধুরী বলয়: হারানো সম্ভাবনার নাম
সিলেট বিএনপির সবচেয়ে পরিচিত মুখ সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যদিও তিনি ছিলেন বিএনপি মনোনীত, তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারদলীয় নেতাদের ছায়াতলে থেকেই তিনি তার রাজনৈতিক পথচলা নিশ্চিত করেছেন। তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং সাবেক সংসদ সদস্য ড. এ কে আব্দুল মোমেনের প্রভাব আরিফুল হকের পক্ষে কাজ করেছে। ফলে তিনি বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন।
দলের অভ্যন্তরে অভিযোগ রয়েছে, আরিফুল হক চৌধুরী কখনোই নিজের বলয়ের বাইরে কোনো নেতাকে গড়ে উঠতে দেননি। নিজের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে গিয়ে তিনি সম্ভাবনাময় তরুণ নেতৃত্বকে দমন করেছেন। এ কারণে একসময় একক নেতা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই সুযোগ হারিয়ে ফেলেছেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও তার ওপর আস্থা হারিয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
খন্দকার মুক্তাদির বলয়: রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের বিভাজন
সিলেট বিএনপির আরেক বলয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন খন্দকার মুক্তাদির। তার পিতা খন্দকার আব্দুল মালেক ছিলেন বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা এবং জাতীয় সংসদের সদস্য। বাবার রাজনৈতিক পরিচিতিকে পুঁজি করে মুক্তাদির জেলা রাজনীতিতে এগিয়ে এলেও সিলেটে দীর্ঘদিন বসবাস না করায় তিনি তৃণমূল পর্যায়ে দুর্বল।
এই সুযোগে তার পাশে গড়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী ‘দালালচক্র’। এই চক্রের মধ্যে রয়েছেন কয়েছ লোদি, সিদ্দিকুর রহমান পাপলু এবং যুবদল নেতা নজিব। কয়েছ লোদি ইতিমধ্যেই বিতর্কিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিউল আলম নাদেলের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগপন্থী লোকদের দিয়ে নিজের ভাবমূর্তি ‘পরিষ্কার’ করার চেষ্টায় রয়েছেন তিনি। সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামানের বাসায় তার নাম উঠে আসা নিয়েও অনেক মুখরোচক কথা সিলেটে প্রচলিত আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিএনপির তৃণমূল কর্মী জানান, আনোয়ারুজ্জামানের সাথে আলোচনা করেই কয়েছ লোদি নিজের নাম আওয়ামীলীগের সাবেক মেয়রের মুখ হতে আনিয়েছেন। তাছাড়া আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিউল আলম নাদেলের সাথে নামে-বেনামে ব্যবসায়িক পার্টনারশিপ কয়েছ লোদিকে আরও বিপাকে ফেলেছে।
সিদ্দিকুর রহমান পাপলু নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। নারী ও ভূমি সংক্রান্ত মামলায় তার নাম উঠে এসেছে একাধিকবার। এছাড়া, তার বিরুদ্ধে দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে। এসব নেতাদের কারণে খন্দকার মুক্তাদির বলয় রাজনৈতিকভাবে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, তরুণ ও ত্যাগী নেতাদের, যেমন সাপ্লাই গ্রুপের আব্দুল্লাহ সফি শাহেদকে রাজনীতির বাইরে সরিয়ে রাখাও মুক্তাদিরের ব্যর্থতার অন্যতম উদাহরণ। শাহেদের কার্যক্রম তৃণমূল পর্যায়ে বেশ জনপ্রিয় হলেও তাকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে রাখায় তৃণমূলের মাঝে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী বিরোধী আন্দোলনে আবদুল্লাহ সফি শাহেদের ভুমিকা সবসময় ছিল তা সকলেই অবগত।
মিফতাহ সিদ্দিকি বলয়: পরিছন্ন ভাবমূর্তি, কিন্তু দুর্বল সংযোগ
তৃতীয় বলয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন তরুণ নেতা মিফতাহ সিদ্দিকি। তিনি একসময় আরিফুল হকের বলয়ে থাকলেও বর্তমানে নিজস্ব বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ব্যক্তিগতভাবে পরিছন্ন ও গ্রহণযোগ্য রাজনীতিবিদ হলেও তৃণমূলের সঙ্গে তার সংযোগ এখনো দুর্বল। ফলে তার বলয় সংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারছে না।
তাছাড়া, মিফতাহ সিদ্দিকিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কিছু নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও ছোটখাটো অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এই নেতারা যদি দলের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে, তবে মিফতাহ সিদ্দিকির রাজনৈতিক সম্ভাবনাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
নেতৃত্বের সংকটে সিলেট ০১ আসন
সিলেট ০১ আসনটি বরাবরই জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব বহন করে এসেছে। এই আসন থেকে মন্ত্রী হয়েছিলেন হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী, সাইফুর রহমান এবং আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মতো হাই-প্রোফাইল নেতারা। বর্তমানে এই আসনে বিএনপির পক্ষ থেকে তেমন কোনো ভারসাম্যপূর্ণ ও জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী নেই বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
সিলেট বিএনপি আজ বহুমাত্রিক সংকটে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নেতৃত্বে স্থবিরতা, দুর্নীতির অভিযোগ এবং তরুণ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি দলকে ক্রমাগত দুর্বল করে দিচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ, সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্ব—যারা শুধুমাত্র অতীতের ওপর ভর করে নয়, আগামী দিনের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোতে পারবে।